#সুখের খোঁজে


ডিভোর্সের কয়েকদিন আগে আমার ননদ আমার রুমে এসে আমার পাশে বসে আমাকে বলল।
"তোমার স্বামী তোমাকে কি জন্য ডিভোর্স দিচ্ছে জানো?"

আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম।
"হ্যাঁ,জানিত। বিয়ের তিন বছরেও আমি তাকে বাবা ডাক শোনাতে পারিনি এটাই হয়তো মেইন কারণ। কিংবা আমি সংসার করার মতো মেয়ে না। আমার কোন দোষ খুঁজে পেয়েছে তাই হয়তো তোমার ভাই আমাকে আর রাখবে না। শুধু তোমার ভাই না তো তোমার বাবা মাও তো চায় না আমি আর এই সংসারে থাকি।"

আমার কথা শুনে আমার ননদ বলল।
"তুমি অনেক বোকা একটা মেয়ে। তোমার সন্তান হয় না তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ার কারণ এটা না। তাছাড়া এখন এসব কারণে কেউ কারো সাথে পবিত্র সম্পর্ক ছিন্ন করে না। টাকা হলেই তো বাচ্চা দত্তক নেওয়া যায়। এরকম নিচ্ছেও অনেকে৷ এতে করে তো আল্লাহও খুশি হয়। একটা গরির ঘরের বাচ্চা আরাম আয়েশে বড় হবে৷ আর আমি যতদূর জানি সন্তান না হওয়ার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামীরা দায়ী। কিন্তু আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে এই দোষটা মেয়েদের ঘাড়ে চাপানো হয়। তোমার স্বামী অন্য কোন কারণে তোমাকে ডিভোর্স দিচ্ছে। বাবা মায়ের কথা বাদ দাও,তারা যেখানে টাকার জন্য আমাকেই বয়স্ক পাত্রের কাছে বিয়ে দিতে চায় সেখানে তুমি তো অনেক দূরে। তুমি এই বাড়িতে আসার পর থেকেই সবকিছু মুখবোজে সহ্য করেছো। কিন্তু যাওয়ার আগে এভাবে সহ্য করো না। আমার ভাই মানুষটা মোটেও ভালো না। তাঁর কাছে মেয়েদের শরীরটাই আগে। তাকে আমি ছোট থেকেই চিনি। তাঁর জন্য আমি আমার কোন বান্ধবীকেও বাসায় আনার সাহস পেতাম না। তোমার স্বামী হয়তো অন্য কোন মেয়ের প্রতি আসক্ত। হতে পারে সেটা তোমার কোন আপনজন। তুমি এত সহজেই হার মেনে নিলে ওরা তোমাকে এভাবেই মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিবে।"

নাদিয়া কথাগুলো বলে চলে গেলো। এই বাড়িতে একটা মানুষই আমাকে কখনো ছোট করে কথা বলে না। আর সবাই আমাকে কাজের মেয়ে ভেবেই একের পর একটা কাজের অনুমতি দিয়ে যেত৷ আমিও বাঁধ্য হয়ে সবার মন রক্ষা করার জন্য কাজগুলো করতাম। আমি চাইতাম সবার প্রিয়পাত্র হতে,সবার ভালোবাসার মানুষ হতে কিন্তু আমি পারিনি। কিছু কিছু মানুষের যতই কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি না কেন সে মানুষগুলো যদি নিজ থেকে একটু কাছে আসতে না চায় তাহলে কখনোই তাদের কাছে যাওয়া যায় না। তারা কখনোই চায়নি আমি তাদের কাছে গিয়ে তাদের কাছ থেকে একটু আদর স্নেহ পাই। অথচ আমি তাদেরকে সবসময় নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গিয়েছি। বিনিময়ে কিছুই পাইনি,সবশেষে পেলাম ডিভোর্স নামক অসহ্য একটা যন্ত্রণামায় উপহার। 

বিকেলে বারান্দায় বসে বসে চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম একটা মানুষের জীবনে কত কষ্ট থাকতে পারে? জন্মের দুইবছর পরেই নাকি বাবা আমাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যান। তাই বাবা নামক মানুষটার মুখ কখনোই আমি দেখতে পারিনি। তার কিছুদিন পরেই মা অন্য একজনকে পুরুষকে বিয়ে করে ঘর সংসার শুরু করেন। অনেক বাবা মায়েরা নাকি নিজের সন্তানের জন্য সংসার,শারীরিক চাহিদা সবকিছুই ত্যাগ করতে পারে৷ খুঁজলে হয়তো এমন অনেক বাবা মা পাওয়াও যাবে যারা শুধুমাত্র সন্তানের কথা চিন্তা করে কখনো বিয়ের কথা মাথায় আনেনি। অথচ তারা চাইলে নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে পারত নতুন কাউকে নিয়ে কিন্তু তারা নিজের যৌবনের সুখ বিসর্জন দিয়েছে সন্তানের সুখের জন্য। কিন্তু আমার মা এতটা ত্যাগী ছিলেন না। তিনি বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। অবশ্য এটা ভেবে ভালোই লাগে আমার মা আমার জন্য তাঁর সুন্দর জীবনটা নষ্ট করেনি। কিন্তু আমি ঠিকই বাবা মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কারণ বিয়ের আগের দিনই আমার মা আমাকে অন্য একজনের কাছে রেখে নিজে বিয়ের পিরিতে বসেছিলেন৷ সাত বছর বয়সে মা আমাকে হোস্টেলে ভর্তি করেন৷ তিনি ভেবেছিলেন বিয়ের কিছুদিন পর আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবেন কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আমি আমার মায়ের সাথে দেখা করতাম, কথা বলতাম। কিন্তু কখনো মায়ের বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর সুযোগটুকু পেতাম না। কারণ আমার মা আমাকে তাঁর নতুন স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যাক এটা ওই বাড়ির কেউ চাইতো না। আর যখন আমার মায়ের কোল ভোরে ফুটফুটে একটা কন্যা সন্তান আসল তখন আমার মায়ের আদরটাও যেন আমার জন্য কমে গেল। আমার বোন আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। সবাই জানতো আমার কথা,জানত আমার মায়ের একটা মেয়ে আছে তবুও কেন আমাকে ওই বাড়িতে নেওয়া হয়নি সেই উত্তরটা আমার কাছে অজানা।

বারান্দা থেকে নিচের দিকে চোখ যেতেই দেখলাম আমার স্বামী আবির একটা মেয়ের সাথে বাসায় ঢুকছে। মেয়েটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর৷ আমি তাঁর সৌন্দর্যের কাছে হয়তো কিছুই না। এই কালো চোখের নীল শাড়ি পড়া মেয়েটাই হয়তো আমার স্বামীকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার দাঁড় প্রান্তে আছে। এই মেয়েটার জন্যই কি তাহলে আবির আমাকে ডিভোর্স দিচ্ছে? আমার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছিল। আমি জানি আবির আমাকে ডিভোর্স দিবে তবুও তাদের দুজনকে এভাবে একসাথে দেখে ভিতরটাতে প্রচন্ড অসহ্যনীয় এক ব্যথা অনুভব করলাম৷

আমি বারান্দায় থেকে উঠে রুমের দিকে গেলাম। ভেবেছিলাম মেয়েটাকে নিয়ে আবির রুমের দিকে আসবে। কিন্তু এমনটা হলো না। আবির মেয়েটাকে নিয়ে তাঁর বাবা মায়ের রুমের দিকে গেল। আমার খারাপ লাগার মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল। বিছানায় শুয়ে কাঁদতে লাগলাম ঠিক এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে আমার শাশুড়ির কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সে স্পষ্ট গলায় বলল।

"বাসায় মেহমান আসছে। ওদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো৷ তার আগে চা বিস্কুট কিছু দিয়ে এসো ওদের।"

কথাগুলো বলে এক সেকেন্ডও দেরি করল না।

ঠিকমতো কাঁদার জন্যও মনে হয় ভাগ্য লাগে যেটা আমার নেই। মানুষ সবকিছু এত সহজভাবে কিভাবে নেয়? আমি কেন পারি না? কয়দিন পরেই আমাকে এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে,আমিও মেনে নিয়েছি। তাছাড়া কোন উপায়ও তো নেই। কারণ অামার অভিযোগ দেওয়ার মতো কোন মানুষ নেই। কেউ নেই যে আমাকে একটু সাহায্য করতে পারে৷ অথচ আমার শাশুড়ি আমাকে এভাবে আদেশ দিয়ে গেল মনে হলো আমি এখনও এই বাড়ির বউ,ভবিষ্যতেও থাকব তাই কাজগুলো আমাকে করতেই হবে।

আমি চা বিস্কুট নিয়ে যখন আবির আর মেয়েটার সামনে গেলাম তখন নিজের প্রতি অনেক ঘৃণা হল৷ নিজের স্বামীকে অন্য একটা মেয়ের কাছে স্বইচ্ছায় তুলে দিতে হচ্ছে বাঁধ্য হয়ে। এক পর্যায়ে আবির আমাকে রুম থেকে চলে আসতে বলল। আমি আর দেরি না করে চলে আসলাম কারণ রুমটাতে আমারও দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই মনে মনে আবিরকে ধন্যবাদ জানাই চলে আসতে বলার কারণে। যদিও সে অপমান করার জন্য এমনটা বলেছে তবুও সে ভালো করেছে।

আটটার সময় আবির মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তাদের চলে যাওয়াটা দেখতে থাকলাম। বুঝতে বাকি রইলো না তারা দুজন হোটেলে রাত কাটাতে যাচ্ছে৷ আমি মনের ভিতর এক আকাশ কষ্ট নিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। কারণ আজ আমার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। একসময় মনে হতো আর কেউ ভালো না বাসলেও আমার স্বামী আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আজ তো সবকিছু নিজের চোখেই দেখলাম। মধ্যো রাতে কারো গালির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। কেউ খুব বিশ্রী ভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছে আর বলছে।
"ওই খানকি, দরজা খোল। দরজা লাগিয়ে কি করোছ? তোর প্রেমিকের সাথে মজা করোস নাকি মাগি?"

আমি শব্দ পেয়েই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখতে পাই আবির মাতাল অবস্থায় এসব বলছে৷ আমার তাকে ধরতে ঘৃণা হচ্ছিল তবুও যখন তাকে ধরতে গেলাম তখন সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেল দিল। তারপর বলল।

"আমাকে ধরেছিস কেন? তুই তো জানিস আমি রাতে আসব তারপরেও কেন দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়েছিস? গরম পানি কর। আমি গোসল করব।"

আমি না বলাতেই সে আমাকে থাপ্পড় মারল৷ আমারও ইচ্ছে করছিল তাঁর গালে থাপ্পড় মারি৷ কিন্তু সাহস হল না কারণ সে পুরুষ আমি নারী। তাঁর সাথে শক্তিতে পেরে উঠব না। পরে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাঁধ্য হয়ে রাত একটার সময় পানি গরম করে দেই। সেই পানিতে আমার স্বামী তাঁর নোংরা দেহটা ধুয়ে ফেলে।

কিছুদিন পরের কথা।
রাত দশটা বাজে,আমি অনেক চেষ্টা করেছি সব কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার জন্য কিন্তু পারিনি। আমার মনে হয়েছে আমার বেঁচে থাকার মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছি তাই মৃত্যুটাকে বেছে নেওয়াটাই আমার জন্য একমাত্র শান্তির পথ। মৃত্যুর আগে আবিরের মুখটা একবার দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে বাসায় ফেরেনি। খুব কম সময়ের জন্য হলেও এই একজন মানুষই আমাকে ভালোবেসেছিল তাই খারাপ হলেও শেষবারের মতো তাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেটা হলো না। সে হয়তো ওই মেয়েটার সাথে মজা মাস্তিতে ব্যস্ত। তাই এখনও বাসায় আসেনি। আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে রেললাইনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষায় আছি কখন ট্রেন আসবে। ট্রেন আসা মাত্রই নিজের মাথাটা এগিয়ে দিব চলন্ত ট্রেণের দিকে। নিমিষেই মুহূর্তের মধ্যে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে একটা জলজ্যান্ত আত্মার সমাপ্তি হবে।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ করে দেখতে পেলাম দুইজন মেয়ে আর একটা ছেলে বস্তায় করে কি যেন একটা রেললাইনে ফেলে যাচ্ছে৷ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বুঝতে পারলাম তারা একজন মানুষকে হাত পা বেঁধে রেললাইনে ফেলে যাচ্ছে। আমার ভিতরটা শুকিয়ে গেল যখন দেখলাম এই তিনজন মানুষকেই আমি চিনি। একজন আমার স্বামী আবির,অন্য জন্য সেই নীল শাড়ি পড়া মেয়েটা। আর যাকে দেখে আমার আত্মাটা প্রতিনিয়ত কাঁপছিল,ভিতরটা ফুলে ফেঁপে উঠছিল সে হল আমার বোন তানিয়া। আমার মায়ের পেট বোন হলেও সে আমার সৎ বোন। আমি তাদেরকে দেখে কিছুটা আড়ালে চলে গেলাম যাতে করে তারা আমাকে দেখতে না পায়।

চলবে...........

গল্পঃসুখের_খোঁজে 
#পর্ব-১

বিদ্রঃ ভালো সাড়া পেলে নেক্সট পর্ব দেব

Comments

Popular posts from this blog

সারজিসউদ্দিলার জমিদার বংশ।

যেতে চাইলে বলো!!!!!

স্বামী_স্তী