পদ্মা সেতু



আব্বা যেদিন মারা যান, ওই দিন সকাল দশটার মধ্যে ঢাকায় থাকার কথা ছিলো। সবকিছু ঠিকঠাক। কিন্তু শিবচরঘাটে এ্যাম্বুলেন্স পৌঁছানোর পর শুনলাম নাব্যতা সংকটে ফেরী বন্ধ। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে দুপুরের দিকে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রাজবাড়ির গোয়ালন্দ ঘাট পার হয়ে মানিকগঞ্জ, সাভার ঘুরে ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা। আব্বা ফার্মগেটের কাছাকাছি থাকা অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যুর সিদ্ধান্ত আল্লাহর হাতে। তবুও সন্তান হিসেবে একটা আফসোস আজীবনই থেকে যাবে। হয়তো সঠিক সময়ে ঢাকা পৌঁছাতে পারলে আব্বা বেঁচে থাকতেন। মৃত্যুর সময়টাতে অন্তত অনেকেই পাশে থাকতে পারতাম।

আমাদের বাড়ি থেকে ঢাকার দূরত্ব মাত্র ১১০ কি.মি.। কিন্তু একটি দিন লাগিয়েও ঢাকায় পৌঁছাতে পারেনি। 

লঞ্চ তখন চাঁদপুরের মোহনায়। মধ্য রাত। মুষলধারে বৃষ্টি, তীব্র ঝড় আর উথাল-পাতাল ঢেউ। ঢেউয়ের সাথে সাথে পানি ঢুকছে লঞ্চেও। গতিপথ ঠিক রাখতে বাতাস সঞ্চালনের জন্য লঞ্চের জানালার কাপড় তুলে দেওয়া হয়েছে। চোখ খোলা যাচ্ছে না বৃষ্টির পানির ঝাপটায়। সবাই দোয়া-দুরুদ পড়ছে। লঞ্চের কর্মচারীরা সবাইকে তওবা পড়ে যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিতে বললেন। অল্প কিছু লাইফ বয়া, তার জন্য হুড়োহুড়ি শুরু হলো। অনেকে সব কিছু ফেলে রেখে কেবল শর্ট প্যান্ট পড়ে স্টিলের স্ট্রাকচার ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন মা। কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য !! আল্লাহর অশেষ কৃপায় লঞ্চ একসময় কোনো এক চড়ে নোঙ্গর করতে সক্ষম হলো। সেদিন দেখা মানুষের অসহায়ত্ব এখনও ভুলতে পারিনি। 

এটি ২০০৪ সালের স্মৃতি। ঢাকা থেকে লঞ্চে প্রথমবারের মতো সদরঘাট থেকে মাদারীপুর গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিলাম। এরপর আর কখনোই লঞ্চে কোথাও যাইনি। যদিও নদীর পাড়ের মানুষ আমি। হাঁটতে শেখার পর পরেই সাতার শিখেছি। উত্তাল আড়িয়াল খা পাড়ি দিয়েছি শত শত বার। ছোট্টবেলায় ব্যাট-বলসহ ত্রিশ/চল্লিশ মিনিট সাতরিয়ে নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরে খেলতে যেতাম। আমাদের পুরো শৈশবটাই ছিলো নদীময়।
 
তবুও ভয় এখনও পিছু ছাড়েনি। এরপর মাওয়ায় লঞ্চে পদ্মা পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকবার ছোট-বড় বিপদে পড়েছিলাম। দক্ষিণ বঙ্গের কয়েক কোটি মানুষ এর ভুক্তভোগী। একজনও বলতে পারবেন না,  অন্তত একবার জীবন হাতের মুঠোয় করে নদী পাড়ি দেন নি। অনেক মানুষের জীবনও কেড়ে নিয়েছে নদীপথের যাত্রা। আর যাদের নদীভীতি রয়েছে তারা ভ্রমনের নামে দুর্বিসহ সময় পার করেন। আবহ্ওায়া খারাপ থাকলে যতোই প্রয়োজন থাকুক, যাওয়ার সুযোগ নেই। প্রিয়জনের মৃত্যুতেও ঢাকায় বসে চোখের জ্বল ফেলা ছাড়া অন্য কিছু করার নেই।  এমন অসংখ্য বাস্তব গল্পের সাক্ষী দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।

আর মাত্র কিছুদিন, এরপর হাজার হাজার বছরের দূরত্ব ঘুচিয়ে দুই পাড়ের মেলবন্ধন হবে। 
পদ্মা সেতুটা অনেকের কাছে কেবলই কংক্রিটের একটি সেতু। কিন্তু আমাদের কাছে এটি একটি স্বপ্ন। আবেগ।  প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের অপেক্ষা শেষে একটি ইচ্ছেপূরণ।

এখনও পদ্মা, ফেরী বা লঞ্চে পার হতে হয়। হা করে তাকিয়ে থাকি। ওই সেতুটা আমাদের। শুধুই আমাদের। ঝড়, বৃষ্টি, ঈদযাত্রায় আর নদীর পাড়ে অহেতুক অপেক্ষা নয়, ঘাট মাস্তানদের খামখেয়ালিপনায় আর কারো জীবনঝরা নয়।

অপেক্ষা, এইতো আর মাত্র কিছুদিন...এরপর  

দুই পিলারের মাঝে যে জায়গা, অনায়াসে তিনটি ফেরী যেতে পারে। সেখানে কেনো বারবার ধাক্কা। ভুল একবার হয়, বারবার হলে তা ষড়যন্ত্র। 

ষড়যন্ত্র বুঝিনা, রাজনীতিও না, খামখেয়ালিপনাও বুঝতে চাই না। শুধু এটুকু বুঝি, পদ্মা সেতুর উপর আঘাতটা মানে দীর্ঘবছর ধরে জমানো আবেগের উপর আঘাত। যেটি সহজেই ছেড়ে দেওয়া যাবেনা। যাওয়া উচিত না।

Comments

Popular posts from this blog

সারজিসউদ্দিলার জমিদার বংশ।

যেতে চাইলে বলো!!!!!

স্বামী_স্তী